সুচেতনা কবিতার ব্যাখ্যা ও মূলভাব
উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রথম পত্রের কবি জীবনানন্দ দাশ রচিত সুচেতনা কবিতার ব্যাখ্যা ও মূলভাব নিচে দেওয়া হলো।
‘সুচেতনা’ কবিতাটি কবি জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। কবি জীবনানন্দ দাশের সুচেতনা কবিতার ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো।
সুচেতনা কবিতার মূলভাব
“সুচেতনা” কবিতাটি জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ (১৯৪২) কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে। “সুচেতনা” জীবনানন্দ দাশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। এ কবিতায় সুচেতনা সম্বোধনে কবি তাঁর প্রার্থিত, আরাধ্য এক চেতনানিহিত বিশ্বাসকে শিল্পিত করেছেন। কবির বিশ্বাসমতে, সুচেতনা দূরতম দ্বীপসদৃশ একটি ধারণা, যা পৃথিবীর নির্জনতায়, যুদ্ধে, রক্তে নিঃশেষিত নয়। চেতনাগত এই সত্তা বর্তমান পৃথিবীর গভীরতর ব্যাধিকে অতিক্রম করে সুস্থ ইহলৌকিক পৃথিবীর মানুষকে জীবন্ময় করে রাখে। জীবন্মুক্তির এই চেতনাগত সত্যই পৃথিবীর ক্রমমুক্তির আলোকে প্রজ্বলিত রাখবে, মানবসমাজের অগ্রযাত্রাকে নিশ্চিত করবে। শাশ্বত রাত্রির বুকে অনন্ত সূর্যোদয়কে প্রকাশ করবে।
সুচেতনা কবিতার ব্যাখ্যা
‘সুচেতনা’ কবিতায় সুচেতনার কথা উত্থাপনের মধ্য দিয়ে কবি মানুষের মাঝে শুভবোধের উদ্বোধন কামনা করেছেন। এই সুচেতনা কবির অত্যন্ত প্রার্থিত আরাধ্য এক চেতনানিহিত বিশ্বাস। আলোচ্য কবিতাটিতে উপমার বহুমাত্রিক ব্যবহারে কবি তাঁর এই অন্তর্গত বিশ্বাসকেই শিল্পিত করে তুলেছেন। এ কবিতায় তাঁর এই বিশ্বাস মূলত দূরবর্তী দ্বীপসদৃশ ‘একটি ধারণা। পৃথিবীর নির্জনতায়, বিচিত্র টানাপোড়েন বা রক্তপাতের মতো বিপর্যয়ে এর ব্যত্যয় ঘটে না। কবির চেতনাগত এই বিশ্বাসই শেষাবধি হিংসার বিষবাষ্প থেকে সৃষ্ট পৃথিবীর গভীরতর অসুখকে সারিয়ে তুলতে পারে। সর্বোপরি এটি আমাদের এক মুক্ত, আলোকোজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ জীবনের স্বপ্ন দেখায় । জীবনমুক্তির এই চেতনাই মানবসমাজের অগ্রযাত্রাকে মসৃণ করবে, শাশ্বত রাত্রির বুক থেকে নেতিবাচকতার অন্ধকার দূর করে অনন্ত সূর্যোদয় ঘটাবে।
কবিতার উৎস
‘সুচেতনা’ কবিতাটি কবি জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। এটি কবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। এ কবিতায় ‘সুচেতনা’ শব্দটির মধ্য দিয়ে তিনি আত্মচেতনাজাত এমন এক সত্যকে উপস্থাপন করেছেন, যা আলোকময় এক সমৃদ্ধ পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায়।
নামকরণ: বিষয়বস্তু অবলম্বনে।
রূপশ্রেণি: এটি একটি আত্মদর্শনমূলক কবিতা।
ভাষারীতি: চলিত ভাষা।
সুচেতনা কবিতার প্রসঙ্গ পরিচয়
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশ। বাংলার প্রকৃতির অন্তলীন সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। এরই প্রকাশ ঘটেছে তাঁর লেখনীতে সংগত কারণে তিনি হয়ে উঠেছেন নিসর্গচেতনার কবি, রূপসী বাংলার কবি। তবে শহুরে নাগরিক জীবনের কথা তাঁর লেখায় খুব বেশি না এলেও এ বিষয়ে তিনি একেবারেই নির্লিপ্ত ছিলেন এমনটি নয়। দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যপ্রীতি তাঁর কবিতায় বিশেষভাবে উপলব্ধ হয়। পাশাপাশি সমসাময়িক সমাজ ভাবনা, শহুরে জীবনের টানাপোড়েন, বিপন্ন প্রকৃতি-পরিবেশ ও জনজীবন নিয়েও ভাবিত ছিলেন তিনি।
আলোচ্য ‘সুচেতনা’ কবিতাটি তাঁর সে ভাবনারই প্রতিফলন। সমকালীন সমস্যাসংকুল বিশ্বে যুদ্ধ, হানাহানি ও রক্তপাতের মতো ঘটনায় উদ্বিগ্ন ছিলেন কবি। চারপাশে নানা বৈষম্য, ভিন্নধর্মী মতবাদ, খণ্ডিত বৈশ্বিক বাস্তবতা তাঁকে গভীরভাবে ভাবিত করেছিল। তবে এসবকিছু নিয়ে ভাবিত হলেও শেষাবধি আশাবাদীই ছিলেন তিনি।
কবিতাটিতে ব্যবহৃত ‘সুচেতনা” শব্দটি তাঁর সে আশাবাদকেই প্রকাশ করে। এখানে সুচেতনা মূলত শুভবোধের প্রতীক; প্রেয়সীর মতোই কাঙ্ক্ষিত। তবে অবস্থাদৃষ্টে কবির মনে হয় তা যেন দূরতর দ্বীপের মতোই অস্পষ্ট। তা সত্ত্বেও একদিন মানুষের মাঝে এই শুভচেতনার জাগরণ ঘটবেই— এ প্রতীতি কবির স্বোপার্জিত অনুভব। কেননা, মানুষে মানুষে সংঘটিত যুদ্ধ, সংঘর্ষ বা রক্তপাতই শেষ কথা নয়। প্রেম, সৌন্দর্য ও মানবিক বোধই সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি। সত্য, সুন্দর ও শুভবোধকে পাথেয় করেই এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে। এরই সঙ্গে ক্রমমুক্তি ঘটবে পৃথিবীরও।