Bangla

নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় কবিতার ব্যাখ্যা ও মূলভাব

উচ্চমাধ্যমিক বাংলা প্রথম পত্রের কবি সৈয়দ শামসুল হক রচিত নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় কবিতার ব্যাখ্যা ও মূলভাব নিচে দেওয়া হলো।

‘নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়’ কবিতাটি সৈয়দ শামসুল হকের বিখ্যাত কাব্যনাটক ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ থেকে সংকলিত হয়েছে। এটি এই নাটকের প্রস্তাবনা অংশ। নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় কবিতার ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো।

নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় কবিতার মূলভাব

“নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়” কবিতাটি সৈয়দ শামসুল হকের বিখ্যাত কাব্যনাটক ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ শীর্ষক কাব্যনাটক থেকে সংকলিত হয়েছে। এটি এই নাটকের প্রস্তাবনা অংশ।

নাটকটির প্রস্তাবনা অংশে সূত্রধর আবেগঘন কাব্যিক বর্ণনার মাধ্যমে দর্শকদের সঙ্গে নাট্যকাহিনির সংযোগ স্থাপন করেছেন। নূরলদীন এক ঐতিহাসিক চরিত্র। রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে সামন্তবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সাহসী কৃষকনেতা নূরলদীনের সংগ্রামের কথা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে। সৈয়দ শামসুল হক ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নূরলদীনের সাহস আর ক্ষোভকে অসামান্য নৈপুণ্যে মিশিয়ে দিয়েছেন বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে।

১৯৭১ সালের ২৫এ মার্চ কালরাত থেকে শুরু করে দীর্ঘ নয় মাস যখন এই বাংলা মৃত্যুপুরীতে রূপ নেয়, যখন শকুনরূপী দালালের আলখাল্লায় ছেয়ে যায় দেশ; যখন বাঙালি হারায় তার স্বপ্ন ও বাক্-স্বাধীনতা, যখন স্বজনের রক্তে ভেসে যায় ইতিহাসের প্রতিটি পৃষ্ঠা— তখন মনে পড়ে ইতিহাসের প্রতিবাদী নায়ক নূরলদীনকে – এই চেতনাই কবিতাটিতে সৈয়দ শামসুল হক তুলে ধরতে চেয়েছেন। ১১৮৯ বঙ্গাব্দে [১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দ] নূরলদীনের ডাকে মানুষ যেভাবে জেগে উঠেছিল, এখনও ঠিক সেইভাবে জেগে উঠবে বাংলার জন-মানুষ- এটাই কবির বিশ্বাস।

এভাবে কবির শিল্পভাবনায় নূরলদীন ক্রমান্বয়ে এক চিরায়ত প্রতিবাদের প্রতীকে পরিণত হয়। ইতিহাসের পাতা থেকে বেরিয়ে এসে নূরলদীন মিশে যায় বাংলার শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের ভিড়ে— অংশগ্রহণ করে সমকালীন সকল আন্দোলন-সংগ্রামে। তাই কবির মনে হয়— অভাগা মানুষ জেগে উঠে পাহাড়ি ঢলের মতো ভাসিয়ে দেবে সকল অন্যায় যখন নূরলদীন দেবে ডাক— “জাগো, বাহে, কোনঠে সবাই।”

নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় কবিতার ব্যাখ্যা

‘নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়’ কবিতায় কবি সৈয়দ শামসুল হক সামন্তবাদ-সাম্রাজ্যবাদের শোষণ ও ত্রাসের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের এক চমৎকার যোগসূত্র তৈরি করেছেন। কবি তাঁর এই কবিতায় যে দৃশ্যকল্প তৈরি করেছেন তাতে দেখা যায়, নীল আকাশে একদিকে অগণিত তারা জ্বলছে, অন্যদিকে তার নিচে অবস্থান করছে উনসত্তর হাজার গ্রাম, গঞ্জ, হাট, জনপদ আর লোকালয়। আকাশে উদিত পূর্ণিমার চাঁদ এসবের ওপর সাদা দুধের মতো ধবধবে জ্যোৎস্না ছড়িয়ে দিচ্ছে।

শাসকরূপী শোষকের অত্যাচারে এদেশের দিগন্তবিস্তৃত সবুজ শস্যক্ষেত, রুপালি নদী, ফসলের বীজ আর অসংখ্য সুখের সংসার যখন নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল তখন দৃষ্টিসীমা অতিক্রমী নীল আকাশে তীব্র শিস দিয়ে কেন যে ওই বিশাল চাঁদ উঠেছিল তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তারপরও সমস্ত স্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে তীব্র স্বচ্ছ এই পূর্ণিমার রাতে মানুষের বন্ধ দরজায় হঠাৎ যেন অতীত এসে হানা দেয় । মনে পড়ে যায় নূরলদীনের কথা। ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের সাহসী কৃষকনেতা রংপুরের নূরলদীন যেন অতীতের খোলস ছেড়ে আবার বেরিয়ে আসেন এই বাংলায়। সবাই যখন কালঘুমে আচ্ছন্ন তখন তাদের জাগানোর জন্যই যেন দীর্ঘদেহী নূরলদীনের আবির্ভাব ঘটে এখানে। শকুনরূপী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন এখানে হানা দেয়, যখন তাদের দোসর-দালালে এদেশ ভরে যায়, যখন এদেশের মানুষের স্বপ্নগুলো লুট হতে থাকে, যখন মানুষের বাকস্বাধীনতা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, যখন এদেশের মাটিতেই এদেশের সন্তানের দেহ থেকে রক্ত ঝরে পড়ে, তখনই এখানে নূরলদীনের আবির্ভাব ঘটে, তাঁর কথা মনে পড়ে যায়।

এমন সময় কারো ঘুমিয়ে থাকা সাজে না। ঘরের ভেতর বসে থেকে একা একা কান্না করাও সাজে না। সব কান্নার জ্বল এক হয়ে তখন ব্রহ্মপুত্রে মিশে যায়। পাহাড়ি ঢলের মতো নূরলদীনের কথা যেন সারাদেশ ভাসিয়ে দেয়। দেশের সব অভাগা মানুষ যেন আশায় বুক বেঁধে থাকে আবার কখন নূরলদীন ডাক দিয়ে বলবেন, ‘জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?”

কবিতার এই নূরলদীন এক ঐতিহাসিক চরিত্র। ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে গড়ে ওঠা সামন্ত ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কৃষক আন্দোলনের তিনি ছিলেন প্রধান পুরুষ। কবি সৈয়দ শামসুল হক তাঁর এ কবিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে অসীম সাহসী এই সংগ্রামী কৃষকনেতাকে একীভূত করে যে শিল্পকুশলতার পরিচয় দিয়েছেন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তা এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

কবিতার উৎস

‘নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়’ কবিতাটি সৈয়দ শামসুল হকের বিখ্যাত কাব্যনাটক ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ থেকে সংকলিত হয়েছে। এটি এই নাটকের প্রস্তাবনা অংশ।

নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় কবিতার অনুষঙ্গ

অবিভক্ত ভারতে দীর্ঘ দুইশ বছরের ইংরেজ শাসনের ইতিহাসে সংঘটিত হয় অসংখ্য আন্দোলন। এসব আন্দোলনের বেশির ভাগই ছিল কৃষককেন্দ্রিক। কৃষক বিপ্লবের দীর্ঘ ঐতিহ্যের অন্যতম হলো রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩), যার নায়ক কৃষকনেতা নূরলদীন। ইংরেজ শাসন ভারতের কৃষি-সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ইচ্ছামতো খাজনা ও কর আদায় করত।

ইংরেজদের শাসন ও শোষণের মাত্রা ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে ওঠে ফলে ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ও বিহারে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে এ দুর্ভিক্ষ রূপ নেয় মহাদুর্ভিক্ষে। এটি ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামেও পরিচিত। এই দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু মানবসভ্যতার ইতিহাসে শাসন- শোষণের ঘৃণ্য নজির যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর উদাহরণ । ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। অনিবার্য ধ্বংস থেকে আত্মরক্ষার জন্য তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

রংপুর বিদ্রোহ প্রকাশ্য রূপ লাভ করে ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে। কৃষকরা বিদ্রোহ পরিচালনার জন্য নূরলদীনকে তাদের নেতা নির্বাচন করে। তারা তাঁকে নবাব বলেও ঘোষণা দেয়। নূরলদীন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং কৃষকদের সংগঠিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতেই বিদ্রোহ প্রবল আকার ধারণ করে। বিদ্রোহী কৃষকরা কর সংগ্রহকারীদের বিতাড়িত করে। বিদ্রোহ দমন করতে ইংরেজ বাহিনী ও তাদের দোসররা নির্বিচারে মানুষ হত্যা শুরু করে।

এর ফলে নূরলদীনের নেতৃত্বে বিদ্রোহী কৃষকরা ইংরেজদের ঘাঁটিতে আক্রমণ করে এবং ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। চতুর ইংরেজ বাহিনীর কাছে নূরলদীন বন্দি হন এবং পরে তাঁকে হত্যা করা হয়। এভাবে রংপুর বিদ্রোহ সমাপ্ত হলেও অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নের কাছে মাথা নত না করার চেতনা হয়ে ওঠেন নূরলদীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button